Sunday, March 26, 2017

আমার পারিবারিক ট্রিপ সমগ্র



আমার সেকেন্ড লাস্ট পারিবারিক ট্রিপ

২০০৫ সাল। ক্লাস ইলেভেন। পুড়কি একেবারে থৈ থৈ করছে। মনের মত একটা মেয়ে বা বিপ্লব পেলেই বাড়ি ছেড়ে দেবো ঠিক করে রেখেছি। জোশ যাকে বলে। নতুন ইস্কুলে গিয়েও চরম পপুলার হয়ে উঠেছি। সকালে উঠেই ইয়েএএএএ জাতের ফিলিং আসছে। এমন সময় ঠিক হলো আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি। সপরিবার।

তো যাচ্ছি। দার্জিলিং। সব মিলিয়ে চিড়িয়াখানা। ঠিক আছে, আমি তো বিপ্লবী এমনিতে হবোই, না হয় তার আগে ঘুরেই এলাম। তাছাড়া মাসিরা এতো করে বলছে।

বেড়াতে যাওয়ার দিন চলে এলো। কাট টু শ্যালদা। ট্রেন সবে ছেড়েছে। আমাদের পাশেই এক ঝাঁক তরুণী। উড়ু উড়ু মন। ঠিক তখনই, আমার মা-

- "বাবান, সকালে উঠে কিন্তু হাগু করে নিস। অনেকটা পথ যেতে হবে। রাস্তায় কিছু পাওয়া যাবে না। তারপর ঘেমে নেয়ে একাক্কার কান্ড হবে"

একটা হাসির হিল্লোল শুনতে পেলাম।

- "জানলাটা নামিয়ে দে না, আবার তো ঠান্ডা লাগবে, এটার কোনো হোদবোধ তৈরী হলো না, মিডল বার্থে শুলে পড়ে যাবি না ট্রেন দুললে?"

আর পারলাম না, অপমানে বেগুনী হয়ে (আমার পক্ষে লাল হওয়া পসিবল না) গর্জে উঠলাম এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। মা খানিক থমকে গ্যালো...তারপর...

- "দেখেছিস টিঙ্কা দ্যাখ দ্যাখ, রাত্তিরবেলা স্বপ্ন দেখে যখন হা হা করে চিৎকার করে তখন মা, সেই উঠে গিয়ে বাবুকে জল দাও। এই সেইদিন অবদি বাথরুমে মাকড়সা মেরে দিয়েছি জানিস...."

আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। টপ বার্থে উঠে। কারণ এ-এছাড়া অপমান থেকে আর কী ভাবে বাঁচবো? কী ভাবে?

এনজিপি এলো। নামলাম। জুলাই মাস। ভয়ানক গরম। নেমেই কে বেশ একটা বললো - বাতাসে একটা আলগা হীম আছে কিন্তু! আমি ভাবলাম তবে কী আমিই ভুল? আমার কী সত্যিই হোদবোধ নেই?

তাপ্পর গাড়ি ঠিক হলো। মা তদারকি করে সব ছাতে তুলে প্লাস্টিক দিয়ে বাঁধিয়ে, আমায় অ্যাভোমিন গিলিয়ে তবে শান্ত হলো। জানলার ধার বাগাতে গেসলাম কিন্তু যেহেতু আমি 'বড়' তাই বোন এক জানলায় ভাই আরেক জানলায় বসলো। সামনে তো বড় একজনই বসবে। তাই আমি পেছনে। গাড়ি ছাড়লো।

এমনিতে সব ঠিকঠাক চলছে। আমাদের বাড়িতে মোটের ওপর সবাই হাসতে জানে। হ্যাহ্যাহ্যাহ্যা শুরু হলো। কিন্তু পাহাড়ি পথ টাচ করতেই সে সমস্ত শান্ত হয়ে  গ্যালো। কারণ যেই না গাড়ি বাঁক দিয়ে ঘোরে অমনি চাপা একটা মিলিত "লোকনাথা বাবা, লোকনাথ বাবা" প্রেয়ার শুরু হয়। এই করতে করতে চায়ের জন্যে দাঁড়ানো হলো।

প্লাস্টিক খুলে সুটকেস নামানো হলো। আমি একটা টি-শার্ট আর জিন্স পরেছিলাম। কিন্তু "জুলাই মাসের এই ঠান্ডায়", টি-শার্টের ওপর উলিকট, হাফ-সোয়েটার, মাফলার, কানঢাকা টুপি পরিয়ে দিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হওয়া গ্যালো। এবার গাড়িতেও চাপাচাপি শুরু হলো। কারণ সবাই ডবল হয়ে গ্যাছে। আবার সেই "লোকনাথ বাবা, লোকনাথ বাবা" কোরাসের পর আমরা দার্জিলিং পৌঁছোলাম।

হোটেলের রিসেপশস্টিদের আমার বোন একটা করে নাম দিয়ে দিলো। অপমানজনক নাম। তাতে সবাই খুউউব খুশি হলো। আবার খানিক হ্যাহ্যাহ্যাহ্যাহ্যা। ভেবেছিলাম একবার বলি এটা ইনসেনসিটিভ। কিন্তু অপমানের ভয়....

এবার আসল সমস্যা। বাথরুমে মগ নেই।

- "এমা, ছুচু করবো কী দিয়ে! কাগজ!!! ইয়েম্যাগো!!"

আবার জোক। এবারের গুলো সান্তাবান্টা লেভেল।

সে সব সামলে ভাত মাছের ঝোল খেয়ে, বেড়াতে বেরুনো হলো। ম্যাল। বেশ লাগছিলো বসে বসে পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকতে, কিন্তু সুখ সইলো না। মার্কেটটা কোন দিকে যেন? শুরু হলো মার্কেটিং। বাচ্চদের হাতে একটা করে জপযন্ত্র দেওয়া হলো।

- "ঘোরা ঘোরা, কীরে ঘোরা না, ঘোরাতে ঘোরাতে চল না"

এরপর হঠাৎ সবাই হোটেলে ফেরবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। আমি কারণটা বুঝতেই পারছি না! ফিরে সবাই আমাদের ঘরে জড়ো হলো। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত এগারোটা অবদী, এখানে মুড়ি পাওয়া যায় না, মোমো আসলে সেদ্ধ সিঙ্গড়া বই অন্য কিচ্ছু না, সব টাকা হাতানোর ধান্দা করতে করতে সিরিয়াল দেখা চললো। দার্জিলিং এ বসে।

সিরিয়াল দেখে হ্যাহ্যাহ্যাহ্যা করে শুতে রাত হলো। তখনও বারোটা বেজে যায়নি তাই বারোটার মত বাজলেই লুটিয়ে ঘুমোতাম। সেদিন প্রায় সাড়ে বারোটা বেজেছিলো শুতে। গভীর ঘুমে হঠাৎ মা ধ্যারফ্যাড় করে তুলে দিলো।

- কীরে, ওঠ, সূর্যোদয়  দেখতে যাবি না?!

ঘড়িতে চারটে। মা দেখলাম পাট পাট করা শাড়িটাড়ি পরে রেডি। বোন ও তাই। চিপস চাইতে আমাদের ঘরে এসেছে। ভোর চারটের সময় চিপস! হাউ????

- জলদি রেডি হ। এখন আর বাথরুম যাওয়ার দরকার নেই। গাড়ি এসে গ্যাছে।

হলাম তৈরী। জাঙ্গিয়া, বক্সার, জিন্স, মোজা, জুতো, নিচে। ওপরে, স্যান্ডো, টি-শার্ট, উলিকট, হাফ হাতা সোয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার, কান ঢাকা টুপি। আমারও চিপ্স খেতে ইচ্ছে হয়েছিলো, কিন্তু হাতটা মুখ অবদি গ্যালো না। দেখে মনে হচ্ছিলো কতগুলো মিষ্টি তোষক চলেছে "সূর্যোদয়" দেখতে।

কাট টু টাইগার হিল।

কে বেশ একটা জিজ্ঞেস করলো, - সূর্যটা কোন দিক দিয়ে উঠছে?

এক বাঙালি পরিবার নিজেদের বলে চিনে নিলো আমাদের।

- এই যে দাদা এদিকটায়
- ও বাবা, বাঙালি, দেখেই বুঝেছি, এই খুদে খুদে চোখের ভিড়ে আপনার লোকের মুখ
- খ্যাখ্যাখ্যাখ্যা

ওদের পরিবারে একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখে রেসিজম ক্ষমা করে দিলাম। পকেট থেকে সানগ্লাসখানা বের করে পরবো কিনা ভাবছি, ঠিক তখনই মা

- এই তো এরা তিন ভাইবোন ছিলোই এখন আপনার মেয়েকে নিয়ে চার ভাইবোন হলো।

সানগ্লাস পকেটেই রয়ে গ্যালো। সূর্য মেঘের আড়ালে। কারণ কোনো বাঙালি পরিবারই আজ অব্দি একবারে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পায়নি। যদি এসবই আসলে ট্যুরিস্ট টানার ষড়যন্ত্র বলে জানা গ্যালো। আমার সদ্যজাত টাইগারহিলতুতো বোনের বাবা তেমনটাই জানালেন।

- আরে ভূগোলফুগোল বলে তো একটা ব্যাপার আছে নাকি! আমদের বোকা পেয়েই... পৃথিবী যে মহাকাশের মত এক্সপ্যান্ড করছে তা তো আর গিন্নি বুঝবেন না।

তারপর আমরা সপরিবার (ওদের ধরে) চা-জলখাবার খেয়ে, আরও কিছু পেট্রিয়ার্কাল, রেসিস্ট জোক আনাদপ্রদানের পর ফিরে এলাম। সেইদিন আর তার পরেরদিনের গোটাটাই অসহযোগীতার গল্প।

মা'য়ের যে জ্যাকেট পছন্দ হয় তা আমার হয় না। আমার যেটা পছন্দ হয় সেটায় যে গরম হবে না তা মা দেখেই বুঝে গিয়েছে। আর তাছাড়া এরপর গ্যাংটক, ছাঙ্গু, বাবা মন্দির! ও বাব্বা! ওখানে নাকি এত ঠান্ডা যে গা থেকে ঘাম ভেঙ্গে ফেলতে হয়। বরফ হয়ে যায় যে!

ওত ঠান্ডায় ক্যানো কেউ ঘামবে তা জানার উপায় অবশ্য নেই। যাকগে দুদিনে যে জ্যাকেট হয় নি, মাসিদের  সাথে বেরিয়ে তা কেনা হয়ে গ্যালো। বলা বাহুল্য মায়ের পছন্দ হয়নি

এইবারে কাট টু একদম গ্যাংটক। দার্জিলিং-এর বাকি ওই দুদিনে বলবার মত ঘটনা তিনটে।

এক, বাতাসিয়া লুপে আবার সেই পরিবারের সাথে দেখা হলো। ভদ্রলোককাকু বললেন উনি ল্যাটিটিউট লঙ্গিটিউড, টাইম, "সূর্যের গতি" ইত্যাদি ক্যালকুলেট করে একা গিয়ে গলে পড়া সরষের তেলের মত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে এসেছেন।

দুই, সেই শুনে আমার আলতো চাপা স্বরে "ঢপ"- বলাটা মা শুনে ফেলে আমায় যা নয় তাই করে বললো।

তিন, গ্যাংটক যাওয়ার পথে তিস্তা দেখে আমি ঠিক করে ফেললাম কবিতা আমায় লিখতেই হবে। কারণ নাহলে গম্ভীর হওয়া যাবে না। এই তখনকার মতই - "চুপ করে বাইরে তাকিয়ে আছিস ক্যানো বোকা, ং দিয়ে গা"- করানো হবে জোর করে।

- এই ছেলেটা মজা করতে জানে না রে!

গ্যাংটকে মার্কেট দেখে সবাই খুউউউব খুশি। হোটেলের বাথরুমে মগ দেখে সবাই আরওওওওও খুশি। গাড়ি ঠিক হলো। পরদিন ভোর ভোর ছাঙ্গু, বাবা মন্দির।

লাইসেম্পি সাজে ছাঙ্গু পৌঁছোলাম। শুধু চোখ দুটো বেরিয়ে আছে সবার। গাড়ি থেকেই দেখা গ্যালো একটা চমরী গাই দাঁড়িয়ে যাছে। সেই দেখে ভাই বললো ওমা!বাইসন!

মাইরি বলছি, ও ইংলিশ মিডিয়াম বলে কেউ মানতেই চাইলো না আমার কথা। সবাই ওটাকে বাইসন বলেই ডাকলো। তারপর দি আল্টিমেট ওয়ান। ওর ওপর উঠে ছবি তোলা। বাইসনের ওপর। সবাইকে তোলা হলো। পোজ দেওয়ানো হলো। একটা চমরী গাই, থুড়ি বাইসন দাঁড়িয়ে থাকলে যে কিছুতেই বোঝানো যাবে না ও চলছে না সেটা কেউ বুঝলো না। বুঝতে চাইলো না...

- চালানোর মত কর, চালানোর মত কর!

এবার মা। মা বাইসনে উঠলো। ছবি তুললো। তুলে যে দিক দিয়ে উঠেছে তার উলটোদিক দিয়ে নামলো। নামার সময় বাইসনের মালিককে লাথি মেরে দিলো। নিজে পড়ে গ্যালো। বাইসন হতাশায় মাথা নাড়লো। পয়সা পেয়ে মালিক তার বাইসন নিয়ে চলে গ্যালো।

এখন সে নাকি চায়ের দোকান দিয়েছে। জনশ্রতি  বাইসনটা বাঙালি দেখলেই খেপে যায়। এমনি "বা" অথবা "বে" বললেই তেড়ে আসে।

কেউ একটা বলতে গেসলো ছাঙ্গুর জল নাকি পবিত্র। কিন্তু বোতলের অভাবে তা আর আনা হলো না। এরপর বাবা মন্দির।

- জুতোটা গাড়িতেই খুলে যাই নাকি?
- নানা এই ঠান্ডায় ওসব দরকার নেই। আর ঠাকুর সব জানেন। মন্দিরে ঢোকার আগে বাইরে খুলে রাখিস।

তারপর দেখলাম হতাশা কাকে বলে। বাবা মন্দির তো মন্দির নয়! এখানে যে মানত রাখা যায় না! তাহলে?? তাহলে মানে কী এই সমস্ত প্রাকৃতি সৌন্দর্যের মধ্যে ঘুরতে আসার, এত কষ্ট করে মানেটা কী যদি মানতই না রাখা যায়?

ফেরবার সময় অবশ্য সবটা পুষিয়ে গ্যালো। আড়াই ফুট বাই তিনফুট বরফ পড়ে ছিলো যে রাস্তায়! এবার শুরু হলো ছবি তোলা।

বরফ আমি ভাইবোন, ভাইবোন আমি বরফ আমি, ভাই বরফ বোন, বোন বরফ ভাই, বরফ ভাই, বরফ বোন, বোন বরফ মাসি, মাসি বরফ আমি ভাই, ভাই মা বোন বরফ, বরফ.....ভাগ্যিস তখন ফিল্ম ক্যামেরা ছিলো, ভাগ্যিস.... আমদের ছবি তোলা শেষ হলে দেখলাম বরফ গলে গ্যাছে।

- এই একটু হাস না গুড্ডু, সারাক্ষণ মুখটাকে প্যাঁচার মত করে রাখিস ক্যানো?
- ওটা ওইরকমই, ভোঁদড়, দ্যাখ দ্যাখ, বলেছিলাম হাগু করে বেরো।

তারপর ফেরা, ফিরে গোছগাছ, পরদিন ট্রেন, বাড়ি। একদিন শিলিগুড়ি থেকেছিলাম আমরা। হংকং মার্কেট গেসলাম। ওই মার্কেটটুকুই হলো আমার সবচাইতে হুরররে স্মৃতি। কারণ আমি এর আগেও একটা লেখাতে বলেছি আমার ছোটোমেসো আমার কাছে সান্তাক্লজ। উনি পড়িয়েছেন আমায় টুয়েলভ অবদি।

সেদিন হংকং মার্কেটি থেকে ছোটোমেসো আমায় একটা নানচাকু কিনে দিয়েছিলো।

কিন্তু সে অন্য গল্প। পরে একদিন হবেখন।

আমার থার্ড ফিনালে পারিবারিক ট্রিপ

এবারে পুরী। তখন সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা চলছে। জীবনে প্রেম আছে, বিপ্লব আছে, বড় চুল আছে, ইংরিজি গান আছে, ফলে বাড়ির লোককে মানুষ জ্ঞান করি না।  আর ফিলিংটা মিউচুয়াল। পরীক্ষা চলছিলো বলে সবাই আগে চলে গ্যাছে। আমি আর বাবা যেদিন গিয়ে পৌঁছোবো সেইদিনটা থেকে পরেরদিন রাতের ট্রেনে ব্যাক। এই হলো প্ল্যান।

দিন চলে এলো। পরীক্ষা দিয়ে, সাক্ষাৎ সেরে বাড়ি। কেউকেটা ভাব করতে গিয়েই প্রথম ধাক্কা। বাপের চোখে  আমি তো বড় হইনি! বাবা মায়ের ইন্সট্র‍্যাকশনে দেড় দিনের জন্যে সাড়েআটসেট জামা নিয়েছে। সেই দেখে আলমারিটায় স্ট্র‍্যাপ লাগিয়ে ব্যাগের মত নিয়ে গেলেই হয়, বলায় আমায় প্রেমিকার সামনেই একচোট অপমান করে তাকে - মা রাতের জন্যে পরোটা করেছি, তুই খেয়ে যা বলে ক্ষান্ত হলো।

আমাদের বাড়িতে আমার সব বান্ধবীর নাম মা। আর বন্ধুর নাম হনু।

এখানে বাবার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে রাখা দরকার।

একদিন বাড়ি ঢুকে দেখলাম হেব্বি ক্যাচাল (একতরফা)। মা চিল্লাছে, বাবা ওসবে তোয়াক্কাও না করে একটা চড়াইপাখি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী না, মা বলেছিলো - টক ডাল করবো, একটু তেঁতুল এনে দাও। বাবা দেড়কিলো তেঁতুল আর একটা চড়াইপাখি নিয়ে ফিরেছে। রাস্তায় পড়েছিলো, দেখে বড় মায়া হয়েছে।

কিন্তু বাবা রজনীকান্ত। পুকুরে নেমে সাঁতার দেওয়ার সময় কেউ জলঢোড়া সাপ দেখলে এড়িয়ে যান বা প্রবল এড়িয়ে যান। কিন্তু বাবাকে আমি সাপ চেজ করে, সেটাকে ধরে, মাথার ওপর বাইবাই করে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে দেখেছি, তাই আমার আর সাঁতার শেখা হয়নি।শুধুমাত্র পয়সা ছিলো না বলে আমার বাবা টোনি স্টার্ক বা ড. স্ট্রেঞ্জ হতে পারেননি।

কারণ বাবার ধারণা বাবা স্যাটেলাইট ছাড়া বাকি সব সারাতে পারেন, সেটা টিভি হোক বা টিবি। টিভি হলে হাতুড়ি আর টিবি হলে বয়রা পাতাটা গুঁড়ো করে নিয়ে.....আমার বাবা একাধারে ইঞ্জিনিয়ার আর বৈদ্যরাজ। আর কোন ভদ্রলোকের বাড়িতে বছরের যে কোন সময় আসলে সে দেখা দেখা যাবে তিনটে আমলকি সেদ্ধ ভর্তি কিশোর কৌটো হাসি মুখে কিশলয় পড়ার মত করে রোদ খাচ্ছে?

আমাদের বাড়িতে দেখা যায়। আর তাছাড়া বাবার হবি হলো প্রতিবাদ। ধরা যাক সেখানে দরকার নেই, মানে প্রতিবাদও চাইছে না তাকে করা হোক, সেখানেও! বাবার পুরোনো পাড়ার গল্পগুলো অনেকটা এমন,

-তারপর আমি তো সালা লুঙ্গি পরে চলে গেছি, এবার আমায় ঘিরে নিয়েছে, আমিও সালা পাশের দোকান থেকে একটা দা তুলে নিয়ে......

সত্যি বলছি, আমার বাবা মিথ্যে বলতে পারে না। আমি জানি এগুলো সত্যি। একবার গেছিলাম বাবার সাথে বরাহনগর। পুরোনো পাড়ায় কিশোর ছেলেকে নিয়ে বাপ কি দেখায়, - এই দেখ, এখানে খেলতাম, ওখানটায় খুউউব দুষ্টুমি করতাম, ইত্যাদি।

কিন্তু আমার বাবা দেবতার ভিক্টর ব্যানার্জী। প্রথমত এলাকায় ঢুকতেই সবাই বাবাকে, গুরু গুরু করা শুরু করলো। তারপর বাবা গল্প করলো,

- ও মালটাকে দেখছিস? ওই যে খুঁড়িয়ে হাটছে, ওকে এখানে মেরেছি, ওই মালটাকে ওখানে মেরেছি....

আচ্ছা আপনি আপনার বন্ধুর ছেলেকে কী বলবেন? - তোর বাবার খুউউউব সাহস ছিলো, আমরা একসাথে খুউউব মজা করছি, নিদেনপক্ষে বাবা কোন ক্লাসে পড়িস ইত্যাদি।

আমায় এক কাকু গালে একটা দাগ দেখিয়ে বলেছিলো

- এ দেখ এটা দিওয়ার দেখতে গিয়ে, তোর বাপ চাকু চালিয়েছিলো।

তো এহেন বাবা আর ব্ল্যাকশিপ আমি গিয়ে পৌঁছোলাম হাওড়া। বাবা হাতে সিগারেট দিয়ে বললো - ট্রেনে খাস না কিন্তু, এখানে খেয়ে নে, আবার নেমে।

ট্রেনে আমাদের সাথে একদল ইয়ং ছেলে ছিলো। তারা মদ খাচ্ছিলো, অবশ্যই ঢেকে। আর হুল্লোড় করছিলো, অবশ্যই খুলে। তবে ছেলেগুলো মোটের ওপর খারাপ না। বাবা দেখলাম একবার ছেলেগুলোকে মাপলো, আমি সেই দেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।

এম্ব্যারাসমেন্ট এড়ানোর রাস্তা আর কিছু ছিলো না। আর বাবার ক্রিপ্টোনাইট মা'ও উপস্থিত নেই। মায়ের সামনে বাবা অন্য মানুষ! আসলে মুখ ঝামটার জয় সর্বত্র। তাই এহেন বাবাও বাধ্য হয় চড়াই পাখিটাকে ছেড়ে দিতে। আর মায়ের কাকেদের বিস্কুট আনতে।

- এই কাকটা বড্ড আদুরে হয়েছে...এই তুই তো একবার খেলি, যা তোর বন্ধু কে পাঠা....

এই সমস্ত স্যুরিয়াল বাক্য আওড়াতে আওড়াতে মা রোজ কাকেদের বিস্কুট খাওয়ান। যদিও এমন বাবা মা আছে বলেই হয়তো আমার ডানার অসুবিধে হয়নি কখনও।

যাকগে, তো পৌঁছলাম পুরী। এর মধ্যে মা বার দেড়শোক ফোন করেছে। গোটা কামরার লোক জানে আমরা এলেই বেরিয়ে পড়া হবে, আজ হোল ডে লিঙ্গেশ্বর মন্দির, নন্দনকানন আর কোনারক! বাওয়া, এসি গাড়িতে যাবো, গাড়ি ড্রাইভাই বিশ্বনাথ উড়ে হলে ভালো লোক, একবার ছোটোবেলায় ওর ডান পায়ে..

স্টেশন থেকে বেরিয়ে, বাপ ব্যাটায় চা-সিগারেট মেরে, আমি বললাম - অটো নিই?

- না না, রিক্সা করে চ, হাওয়া খেতে খেতে যাবো

মিঠুনের সিনেমার জটিল নায়েবের মত একটা রিক্সাওয়ালও বলল তিন মিনিটের পথ, এইতো দেখা যাচ্ছে হোটেল। মা এতবার তাড়া মেরেছে ভাবলাম রিক্সাতেই ব্রাশটা করে নিই, তিনমিনিট তো...

চল্লিশ মিনিট পর হোটেলের সামনে পৌঁছে একটা নালা পেয়ে তবে আবার নাক দিয়ে শ্বাস নিলাম। এই গোটা পথটা বাবা আর সেই রিক্সাওয়ালা আমায় নিয়ে খুবই খ্যাখ্যাখ্যাখ্যা, বোকা রে ট্রেনেই মাজতে হতো, আরে সবাই রাস্তায় ফেলছে তুইও ফ্যাল না, করেছে, মিলিত ভাবে।

রিক্সাভাড়া চুকোতেই একটা অ'মাইক গলা ভেসে এলো, তিন তলা থেকে, মায়ের গলা-

- এতো দেরী হলো ক্যানো? পরীক্ষা ক্যামন হয়েছে? ট্রেনে ঘুম হয়েছে? ওই দ্যাখ সমুদ্র! দ্যাখ দ্যাখ! দাঁত মেজেছিস? সোজা সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে এসে বাথরুমে ঢুকে যা, দেরী হচ্ছে তো, আয়, ওমন করে তাকিয়ে আছিস ক্যানো, জল ভরে রেখেছি, আয় আয় জলদি আয়, কিগো এসো...

এই গোটাটাই তিনতলা থেকে একতলায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের কমিউনিকেট করা হলো, কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে।

গেলাম "সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলায়"। সবাই মোটের ওপর বেশ খুশিয়াল।

- চিল্কায় যে কী জল কী জল, কী বলবো! ওব্বাব্বা! সে আমাদের কী ভয়! ভাগ্যিস তুই যাসনি, আমি তো ওখানে একজনকে বলছিলাম বাবান যা ভীতু, সাঁতারই শেখাতে পারলাম না, এলে ভয়ে উঠতোই না নৌকোয়!

- কাকে বলেছো?!

- ওই তো কতগুলো কলেজের মেয়ে ছিলো আমাদের সাথে।

রেডি হয়ে নামলাম। অপমান নিয়ে নামলাম.... রেডি হয়ে। রেডি মানে চা খেয়ে, সিগারেট ফুঁকে। খাওয়া দাওয়া বাইরে। আমি ছিলাম না বলে সেরা জায়গাগুলো আজকে দেখা হবে। এই লেভেল ওফ ভিআইপি ট্রিটমেন্ট...ভাবতে ভাবতে চুলে টাওয়েল জড়িয়ে বেরোলাম, আর মা

- দুটো বিনুনি বেঁধে আমার একটা নাইটি পরে নে...একটা গাডার রাখা যায় না বাড়িতে, নবাব ঝুঁটি বাঁধবেন খ্যাখ্যাখ্যা (আমি জানি এটা নিয়ে কমেন্টের ঝড় বয়ে যাবে, কিন্ত কী আর করা)

এসি গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এসি গাড়ি। এসি গাড়িতে যাচ্ছি আমরা, ঠিকাছে, এসি গাড়ি! বুঝলে এসি গাড়ি! কেউ গ্যাছে এর আগে এসি গাড়িতে? এসি গাড়ি....এসি.....গাড়ি....

এসি...

প্রথম যাওয়া হলো লিঙ্গরাজ মন্দির। সেখানে চামড়ার কিচ্ছু পরে যাওয়া অ্যালাউ না। এইবার আমার কোমর ছব্বিশ ইঞ্চি। আমি যদি বেল্ট খুলি তাহলে প্যান্টখানা দু-হাতে ধরে রাখতে হবে। তাই বললাম আমি যাবো না ভেতরে।

- শাল্লা, দিওয়ারের অভিতাভ তো গুড্ডুভাই ( আমার ভাই-বোনরা আমায় কেউ দাদা বলে না, ও নামেই ডাকে)

বাবা দিলো আওয়াজটা! খানিক সন্মিলিত খ্যাখ্যাখ্যাখ্যা, মা কনফার্ম আমার জীবনে কিচ্ছু হবে না (কিছু হয়ও নি, এটাও ফ্যাক্ট!)

তাই কোমরের দিকটা কোনরকমে গুটিয়ে ভেতরে গেলাম। গিয়ে থ হয়ে গেলাম। পাথরের গায়ে ইতিহাস খোদাই করে ছেড়েছে পুরো! এর আগে আমি এসমস্ত দেখিনি, বা দেখলেও বুঝিনি, ওহ কী দেখলাম! বেশ ঘুরে ঘুরে দেখছি, দারুণ সমস্ত কাজ, কিছু জায়গায় ভেঙ্গে গেছে দেখে এই নিয়ে কী আন্দোলন হতে পারে তাই নিয়ে প্যাঁচ কষছি, এমন সময় ভাই এসে বললো আমাকে সবাই খুঁজছে।

গিয়ে দেখলাম মা কাঁদছে, না না আমি হারিয়ে গেছি ভেবে না, ভক্তিতে...নেহাৎ অনেকটা দূর তাই জুতসই একটা মানত রাখতে পারেনি। একমাত্র দুই মেসো ছাড়া বাকি সবাই একরকম জানে আমাদের সমস্ত দুঃখ আজ হইতে শেষ। আমাদের মানে আমার মায়ের, আমাকে নিয়ে। আমি কথা ফথা শুনবো বলেও জানা গ্যালো এবার থেকে।

তারপর আমরা গেলাম নন্দনকানন। গাইডফাইড নেওয়া হলো। গাইড মানে সেই লোকটি যার সাথে আমাদের ফারাক বাক্যগঠনের। যেমন

আমরা - এই এই এদিকে সিংহ! আহ তুতুতুতুতুতুতুতুতু

গাইড- এই যে এদিকে পশুরাজ সিংহ,... সামশের

সেখানে আমার মা ঈগল দেখে ম্যকাও বলায় কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু বোন পিকক বলতে গিয়ে পিকাচু বলে ফেললো।

- তোকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি এসে চড় মারবে

বলায় সে "ও বসিইইইইইই (বড় মাসি, মানে আমার মা) দেখো না..." করলো আর মা- "কী?? চড় মারবি বলেছিস..."..... অপমানের পর অপমান, হয়ত আরও হতো কিন্তু ঠিক তখনই একটা সাদা ময়ূর পেখম মেলে দিলো আর সব্বাই সব রাগঝাল ভুলে ঝলমলে হয়ে গ্যালো। এই জন্যেই আমি এত্ত পশুপাখি ভালোবাসি।

প্রতিটা জায়গায় বেড়াতে গিয়েই আমার মা আর বাবা ফেরবার ঠিক আগের দিন একটা অযৌক্তিক ঝগড়া করে। এবারেরটা লাঞ্চ করতে গিয়েই শুরু হয়েছিলো। কারণটা মনে নেই। দরকার ও নেই। কারণ রাতের দিকে এই কনক্লুশনেই আসা হবে ঝামেলার মূল কারণ আসলে আমি।

এই যে আজ মন্দিরের পান্ডা আমাদের ঠকিয়েছে, ক্যানো? কারণ আমায় নিয়ে টেনশন করতে গিয়ে বাবা আর মা ওকে ধরতে পারেনি! ভাবা যায়? বাবা আর মা, চাচা চৌধূরীও যাদের সমঝে চলে, তাদের ঠকিয়েছে! শুধু আমায় নিয়ে টেনশন করছিলো বলে।

সেখান থেকে যাওয়া হলো কোনারক। সেখানেও সবাই দু-দলে ভাগ হয়ে গ্যালো। একদল গ্যালো ঠাকুর খুঁজতে, বাকিরা, মানে ম্যায় ওউর মেরি তানহাই গেলাম আবার ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম অপূর্ব সব কারূকাজ। আবার ভাই এসে বললো তোকে খুঁজছে, আবার গেলাম। নাহ! এবারের কারণ আধ্যাত্মিক নয়। ছবি তোলা হবে। চাকার সামনে।

কোনারকের চাকার সামনে ছবি তোলা পবিত্র।

সেখানে আড়াইঘন্টা মত ছবি তোলার পর বেরিয়ে আসা হলো। বাবা আর মার ঝগড়াটা বেশ পাকছে। হোটলে এসে ফুল শেপ নিলো। খানিক্ষন পর গালাগাল করে থামাতে যাবো ভেবে ওঘরে যেতেই বাবা বললো

- তুই রাতে ফোন করবি তো? ব্যালেন্স আছে? এখানে কিন্তু বেশি টাকা কাটবে, এসটিডি!

আমি খুব খুশি হলে বা ভয়ানক দুঃখ পেলে প্রকাশ করতে পারিনা। মানে জাস্ট পারিনা। সেরকম কেউ হলে জড়িয়ে ধরি। বাপটাকেও তাই করে বললাম - "না যার সাথে কথা বলবো সে ভরিয়ে দিয়েছে" (সিনেমা দেখানো, খাওয়ানোর ইত্যাদির মতন।)  মা বললো

- মেয়েটার জন্যে কী নিবি?

মাকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছি, বোন চলে এলো আর মা আমায় দুদ্দুর করে তাড়িয়ে দিলো। অসভ্যের মত তাড়িয়ে দিলো। খুব খারাপ ভাবে তাড়িয়ে দিলো...তাড়িয়ে দিলো।

আমি তাই বেরোলাম ভাইকে নিয়ে, ঘুরে এলাম চারপাশ থেকে। এসে দেখলাম ঝগড়া শেষ করে গোটা পরিবার সেক্সিস্ট আলোচনা করছে। সন্ধ্যাবেলার মুহূর্তটার কথা ভেবে ক্ষমা করে দিলাম। তারপর আমিও খানিক খ্যাখ্যাখ্যাখ্যা করলাম সবার সাথে, খেয়েদেয়ে এসে, সব ভাইবোন একঘরে।

দেখলাম সবারই রাতে কথা বলার লোক আছে! বেশ ভালো লাগলো। পরদিন সারা সকাল সমুদ্রে চান, রাতে ফেরা।
আমার থার্ড ফিনালে পারিবারিক ট্রিপ।

আজ সমুদ্র। চান ফান হবে হুল্লোড়ের নামে। যদিও পুরীর সমুদ্র কিন্তু দীঘার মত নয়! কোনো চালাকি চলবে না! এখানে হেব্বি কারেন্ট জলে! একবার তো একটা গোটা নীল তিমি, মানে গাদা পেটিফেটি সমেত চলে এসেছিলো কারেন্টে ভেসে। তারপর কতগুলো পান্ডা ঠেলেঠুলে জলের কাছটায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে কোনোরকমে সাঁতরে আবার ফিরে গ্যাছে।

কথাটা শুনে দা ওল্ড ঢপ অ্যান্ড দা সি বলেছিলাম। ভাগ্যিস কেউ বোঝেনি!

এখন গোটা পৃথিবীর মানুষের সমুদ্রে চান কত্তে কী কী লাগে?

ইচ্ছে, সমুদ্র আর স্যুইমসুট।

কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের সমুদ্রে যেতে লাগে?

অবশ্য এবং অবশ্যই জলে ফাঁড়া না থাকা, চল চল, দাঁড়া আজকে কষে গ্যাছে, ওরে চল রে, হাফপ্যান্ট, গামছা, জলের বোতল, চুড়িদার/নাইটি, গামছা, হাওয়াই চটি, ডাবওয়ালা, গামছা, সামগ্লাস, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট রাখার প্লাস্টিক, গামছা, আর এই সমস্ত কিছু পাহারা দেওয়ায় মত সৎ ( যারা হাওয়াই চটি চুরি করবে না) চেয়ার টেবিলওয়ালা, গামছা.... তোয়ালে...গামছা...

এইসমস্ত বিবিধ রতন সংগ্রহ করে আমরা সমুদ্রে পৌঁছোলাম। সমুদ্র আর আমায় একসাথে পেলে আমার বন্ধু আর পরিবার মিলেমিশে একইরকম রেসিস্ট আর ইনিসেনসিটিভ হয়ে ওঠে। নুলিয়া ভাইদের সাথে আমার এত মিল তাও আমি সাঁতার জানিনা, ইহাই প্রধান উপজীব্য। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমায় রূপগুণ কিছু না দিলেও খানিক স্পোর্টিং স্পিরিট দিয়েছে এই যা রক্ষে।

এরপর শুরু হলো চা্ন। চান মানে বাকিদের হাঁটু জলে নেমেই স্কুবা ডাইভিং-এর ফিল নেওয়া আর মা বাবা এবং মেসোর আমার নুলিয়া ভাইরাও যদ্দুর যেতে চায় না, শুধু একখানা টিউব সম্বল করে তদ্দুর চলে গিয়েও "দূর, এতো হাঁটু জল" আস্ফালন। এছাড়া জোর করে ঘাড় ধরে ছবি তোলানো তো আছেই।

পোজগুলো সাধরণত এমন।

ঢেউ ঝাপটা মারছে। চোখ বন্ধ করে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ঢেউ ধরতে যাওয়া হচ্ছে। ঢেউ গোটা পরিবারকে একসাথে ঝাপটা মারছে। চুল দুয়ে নুন গড়িয়ে পড়ছে।

এমনিতে মানুষ সবচাইতে বেশি সচেতন থাকে মাল না খাওয়া অবস্থায় নাচার সময় আর ছবি তোলানোর সময়। কিন্তু আমার কাছে আজ অব্দি পরিষ্কার হলো না নিজের সবচাইতে কুৎসিত অবস্থার, পয়সা খরচা করে সবচাইতে কুৎসিত ছবি তুলিয়ে মানুষ মজাটা কী পায়?

যাকগে। এই সমস্ত চলল বেশ খানিক্ষণ ধরে। নিয়ম করে ঝিনুক ফিনুকও কোড়ানো হলো তার মাঝেখানে, যেগুলো প্রতিবারের ন্যায় এবারেও হোটেলেই রেখে ফিরে যাওয়া হবে। বেশি জল বেশি শাঁসের মিউটেন্ট ডাব ক্যানো দিচ্ছে না তাই নিয়ে ডাবওয়ালাকে খানিক হেনস্থা করা হলো। সে বোঝাতেই পারলো না একটা কারণ আছে যে নারকোল নারকোল আর ডাব ডাব।

এসবের মধ্যেই হঠাৎ বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এইটে প্রতিবার হয় সমুদ্রে গেলে।  বাবাকে সাময়িক পাওয়া যায় না। মা শিওর থাকে লোকটা ক্র্যাকেনের সাথে লড়তে চলে গ্যাছে, সবাই বলে মাথার ওপর ঈশ্বর আছেন, আমি প্রথমবারের পর আর ভয় পাইনা বলে আবার প্রমাণ হয়ে যায় আমি বখে গেছি, আমি সিগারেট খাই বলেই মার ইউরিক অ্যাসিড ধরা পড়লেও পড়তে পারে।

এইবার বাবা ফিরে বললো গামছা জলের বোতল আর হাওয়াই চটিগুলো "সাইড" করে এসেছে। বেকার ক্যানো পয়সা দেবো? সেই পয়সায় ছবি তুললে কাজে দেবে!  তাছাড়া বাবা নাকি এমন ব্যবস্থা করে এসেছে উঠেই একেবারে কুলকুলে ঠান্ডা জল খাবো আমরা।

এই ঘটনার পর থেকেই বাবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দেখলে আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি।

বাবা আসলে এই সমস্ত জিনিস বালি খুঁড়ে পুতে রেখে এসেছিলো। বালির ভেতর কিছু থাকলে সে জিনিস ঠান্ডা হয়। সব ঠিকই ছিলো। খালি চিহ্ন রাখতে ভুলে গেছেন ভদ্রলোক।

মধ্যবিত্তে পরিবারে সোনা হারিয়ে যাক, কপালে লেখা ছিলো বলে মেনে নেবে, কিন্তু উডল্যাণ্ডের প্লাস্টিকের প্যাকেট হারিয়ে ফেলে দেখো দেখি একবার!  সেখানে আবার হাওয়াই চটি, আর গামছা! গামছা হারানো? ওদের ধম্মেও সইবে না।

মিষ্টি বাবাটাকে কী মুখঝামটাটাই না দিলে! সামনেই হোটেল। একটুই হাঁটতে হবে। ভাগ্যিস হাওয়াইগুলো ছেলেদের ছিলো, কারণ বোনকে যদি হেঁটে ফিরতে হতো...খালি পায়ে... বাবা টের পেতো এম্পাওয়ারমেন্ট কী জিনিস!

এবার হোটেলে ফিরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে চললো পুরী আসবার সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ কাজ। যে শদেড়েক কুইন্টাল খাজা কেনা হয়েছিলো তার ভাগ বাটোয়ারা। কাকাতুয়া বাংলা বলতে পারলে পরিষ্কার বাংলায় মেড়ো বলে গালাগাল করতো এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তারপর লজ্জা কেনা হয়েছিলো কিছু। সেসমস্ত সারপ্রাইজ গিফটাগিফটিও চললো। আমার জন্যে একটা নামাবলি ফতুয়া।

সেইটে পরে যে আমায় অক্ষয় কুমারের মত লাগবে এ একেবারে মাসিদের তুমুল ধারণা।

যথারিতি ট্রেনের সময় হলো। স্টেশনে গিয়ে পৌঁছোলাম। বেড়াতে গিয়ে ফেরবার সময় কারোরই কোনোদিনও একসাথে সিট পড়ে না। এবারেও পড়লো না। আমি একেবারে যেখানটায় সবচাইতে কম সিট পড়েছে সেই জায়গাটাই বেছে নিলাম। জানলার ধারে বসে চুলে হাত বোলাতে দেখলাম বালি লেগে আছে এখনও।

মনখারাপ করেই ফেলতাম হয়তো। আর কিছু লিখেও ফেলতাম, কিন্ত এর মধ্যেই মা এসে বললো...

এটা যারা গেস করতে পারবে না তারা আগের লেখাগুলো পড়ে নেবেন। আর যারা পারবেন তাদের জন্যে কোনো পুরষ্কার নেই।

3 comments:

  1. Is this the original blog of Soumit Deb? He is the author of this.

    ReplyDelete
  2. Wynn casino and sportsbook - Mapyro
    Wynn Casino Resort offers 상주 출장샵 gambling options, including craps, blackjack, 광명 출장안마 roulette, craps, craps, 양주 출장마사지 to play 의정부 출장안마 poker and casino games for real 동두천 출장샵 money.

    ReplyDelete