Tuesday, January 1, 2019

আসা যাওয়ার মাঝে...




...ছুঁয়ে যাওয়া হাত, ছুঁয়ে থাকা হাত হয়ে যাওয়ার মাঝের সময়টুকুর মৌতাত...

আমাদের সময়ে দেখেছি কলকাতা বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। রাস্তাঘাটের মানে, তাদের আলোর মানে, তাদের অন্ধকারের মানে, চেনা অচেনার ভূগোল থেকে বেরিয়ে এক একটা আস্ত ডাকনাম। এ রাস্তায় নেমে এসেছিলো মেঘ, ও রাস্তায় ঝগড়া হয়েছিলো, সেই মোড়টায় আলটুসি হাওয়ার উড়ে গেছিলো দেরী৷ সেই রাস্তাটা আমার চেনা ছিলো না কোনোকালে। সেই রাস্তাটাতে লুকিয়ে পড়েছিলো দাগ৷ সেই লোডশেডিংয়ের সময় হাতে গলা মোম পড়লে ব্যথা লাগে যেমন, তেমন। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা হাজার রাংতার ময়ূরপঙ্খি। উড়ে যাচ্ছে কাপাসতুলোর মতো নরম। বিদেশে চলে যাওয়া বন্ধুর ফোন বেজে গ্যাছে ও রাস্তায়৷ ধরিনি৷ টানের কথাই যদি ওঠে, তবে সে কথাই তো হচ্ছিলো, তাই না? এমনিতেই রাতের দিকে অটো পাওয়া বেজায় মুশকিলের কথা। টাকা জমিয়ে জন্মদিনের গ্রিটিংস কার্ডের আদর। উড়তে লজ্জা পাচ্ছে, উড়তে বেজায় লজ্জা পাচ্ছে ডানা।

আমাদের সময়ে দেখেছি গানগুলো বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। তখন কিন্তু সুর বলতে মেজর মাইনর অতীত। একেকটা গান যেন টাইম মেশিনের চোরাকারবারী। মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া ছেলের মতো গলি বেয়ে বেজে চলেছে ইতিহাস। আমাদের গল্প কত না বার রূপকথা হলো তার ইয়ত্তা নেই! প্রতিটা ছত্রে মনে পড়ে যাবে একেকটা চাওয়া৷ একেকটা তাকানো। ঘাঁড় বেঁকিয়ে, সুচিত্রা সেন পোজে চোখে চোখ৷ যত্নের হাসি৷ জানলা দিয়ে তখনও হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ত না জ্যামের বাদ্য৷ সুরের টানাপোড়েনে জেল হয়ে যাচ্ছে রঙিন আবিরের৷ আবিরে দেখিনি, দেখিনি পাহাড়ে, দেখি সমুদ্রের কাছাকাছি কখনও, তবু অমুক গানের মতো দেখতে লাগে নিশ্চয়ই৷ নিশ্চয়ই তমুক গানে ও কথা বলা আছে। গ্যাসবেলুনের ছবি পাতায় পাতায়। তার ছায়া, মাটিতে পড়ে না। কে জানতো ও গানে রাখা আছে কাজল পরা তুলোট। কে জানতো ও গানে পূর্ণিমা নামে নাকছাবি। বাদবাকি বেরঙা দিনপত্রের চিত্রনাট্য তুড়ি মেরে বেমালুম ভ্যানিশ। ইস্টম্যান কালারে কালো শাড়ি। করতলে চেপেচুপে ধরে রাখা ব্যক্তিগত। উড়ে গেলে, পুকুর পারের হাওয়া ছোঁবে কী?

আমাদের সময়ে দেখেছি বোকামোগুলো বদলে যাচ্ছে একের পর এক৷ ডাকনামের প্রতি জন্মানো আনুগত্য। ঘুরতে না যেতে চাওয়ার অন্তরাল। নেটওয়ার্ক থাকবে? সে যে নিজেও যে শহরে নেই, যদি ফোন করলে না পায়? তখন? তখন কি নীরবে থেকে যেতো গোলযোগপূর্ণ বেওয়ারিশ অক্ষর? নকশিচিঠিতে সাহস বেড়েই গ্যাছে। লুকোব ক্যানো হে? শত্রুপক্ষ তো নই! অমুকতমুক হ্যানত্যানের ভিড়ে রোজ কোচিন যাওয়ার, কয়েন ফেলে গলা শোনার দিনকালে যখন ময়দান পেরুইনি, তবে এখন ভাঙবে ক্যানো পিকনিক? এমন চমৎকার শীতে, ম্যাটাডোরের মাথায় আদরনামা হিমের আড়ালে রোদ্দুর এসে পড়ুক। তেমন হলে না হয় সরিয়ে দেব ছাত। সারা শরীর বাগান করে দিক সেই রোদ্দুর। ও আমি নিজের ভুলে সামলে নেব। হোঁচট তো আর কম খাইনি!

আমাদের সময়ে দেখেছি ব্যাথা সয়ে গ্যাছে। ওষুধ খেতে হয়নি। লুকিয়ে রাখা, ধরা পড়ার জাগতিক ভ্রমে তোলা বিপন্ন পাঁচিল বড় হয়েছে আস্তে আস্তে। পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর দাঁড়িয়েও ওপার ছোঁয়া যায় না। পুর্নবার মৌতাতের চেষ্টা, ছুঁয়ে যাওয়া হাত, ছুঁয়ে থাকা হাত হয়ে যাওয়ার মাঝের সময়টুকুর মৌতাত। ঘরের কাছাকাছি এসেও থমকে যাওয়া ডাকপিওন। বারবার বদলে গ্যাছে ঠিকানা। বাক্স ভরা কলেজের গল্প হাতড়ে কতোই না বুঝতে চাওয়া মনের মতো হয়েছি? আমাদের সোনার কাঠির সিন্দুকে রাখা ছিলো বন্ধুত্ব৷ রাজকন্যেকে ছুঁয়ে দিলেই চুলের কাঁটা হারিয়ে যেতো না ব্যাগে৷ যায়ওনি। গ্যাছে কিছু অদরকারি জিনিস। মান গ্যাছে, অভিমান গ্যাছে, পড়ে আছে শুধু নিরুদ্দেশ। মমতাময় স্থিতিশীলতা। সাহসের ঝুলি ঠনঠনে। পাখির মনের ভুলে ফেলে যাওয়া পালক, ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে বেঁচে যায় কয়েকটা চোখ। কাজল ছাড়াও একইরকম আখরদানি। রাস্তা দেখছে, গান শুনছে, বোকামোয় বিরক্ত হচ্ছে দেদার। এখন পরিস্থিতি বিপদমুক্ত। ভালোবাসার চিঠি লেখবার সময় হাতে লেগে যাওয়ার কালির দিকে কি ভাবে চেয়েছে সে চোখ জানা নেই। সবটা কি আর জানা যায়?

শুধু বলা যায়, বা হয়তো যায় না, বা হয়তো যায়,

এই ভীষণ চকমকে শহরটায় ট্যাক্সির রঙ হলুদ। রেডরোডের রঙ বিকেল। বিকেলের রঙ জানলা। কোনো এড়িয়ে না যাওয়ার মতো দেখা হয়ে গেলে, সে সব নিয়ে ছবি আঁকাটা আবার শুরু করা যায়। এই ভীষণ রূপকথার শহরটায় আসা যাওয়ার মাঝে, একদিন, কোনো একদিন, কোনো একদিন...